Wednesday, August 28, 2013

ঘুমপাড়ানি গান

শব্দের ইতিহাস জানার জন্য একটা বিষয় আছে বলে আমি জানি। ইংরেজিতে তাকে Etymology বলে। কিন্তু আমাদের দেশে বিভিন্ন ভাষায় কিছু অনবদ্য ঘুমপাড়ানি গান আছে যা শুনলে সত্যি জানতে ইচ্ছে করে যে এই সব গানগুলোর উৎপত্তি কোথায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই সব গানগুলোর ইতিহাস জানার কোন উপায় অন্তত আমার জানা নেই।

আমাদের ছেলেবেলায় এরকম বেশ কিছু গান শুনে আমরা সবাই ঘুমিয়েছি, কিন্তু আজ আমরা কোন এক অজ্ঞাত কারণে আমরা সেই সব গান ভুলে গেছি - এ বড় দুঃখের। আমাদের মা, কাকিমা, জেঠিমা যারা আজও বেঁচে আছেন, একমাত্র তাঁরাই আজ এই গানগুলো জানেন।

এই ধরনের বাংলা গানের কথা উঠলে যার কথা মনে পরাটা অবশ্যম্ভাবী তিনি হলেন আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর অনবদ্য গায়কী এবং মায়াবী কণ্ঠস্বর আপনা থেকেই আমাদের ঘুমের দেশে নিয়ে যায় - যেখানে শুধু নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পরা যায়। অথচ দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে আজকের বোধহয় কোন শিশুই তাঁর গান শোনেনি। আমি অত্যন্ত ভাগ্যবান যে তাঁর গান শুনে আমি ছোটবেলায় ঘুমোতে গেছি। Gramaphone Mono sound এ তাঁর মায়াবী কণ্ঠস্বর যে কি জাদু সৃষ্টি করত তা মনে পরলে আজও এই বয়েসে এক অনাবিল প্রশান্তি নেমে আসে।

আমরা অনেকেই আজ বাবা কিংবা মা হয়ে গেছি এবং আমাদের অনেকেরই সন্তানরা ঘুমোবার সময় জ্বালাতন করে। একটু ধৈর্য ধরে যদি তাদের আমরা এই সব গান এবং ছেলেবেলায় শোনা গল্পগুলো শোনাই, তবে তারাও সেই একই ভাবে ঘুমের দেশে পাড়ি দেবে যেমন আমরা তাদের বয়েসে দিতাম।

অথচ এই ধরনের ঘুমপাড়ানি গানগুলো, আমার জানা এমন কোন জায়গা নেই যেখানে একসাথে পাওয়া যায়। যদিও বেশ কিছু CD/ DVD পাওয়া যায় যেখানে বিভিন্ন ছড়ার গান এবং ঘুমপাড়ানির গান আছে। সৌভাগ্যক্রমে সেই সব Youtube এও পাওয়া যায়। তবু কিছু গান আছে যা কোথাও record বা নথিভুক্ত করা নেই।

যদি কেউ কখন  আমার নথিভুক্ত করা ঘুমপাড়ানি গানগুলো ছাড়াও অন্য আরও গান জানেন, যেগুলো youtube বা CD/DVD/internetএ নেই, তবে আমায় জানাতে ভুলবেন না please. আমাদের প্রজন্মের সবাইকে আমার একান্ত অনুরোধ যে আমরা যেন এই সব গানগুলো হারিয়ে না ফেলি।

দুটো গান আমার এই মুহূর্তে মনে পড়ছে যা Youtube এ আমি পাইনি। মনে হয় কোথাও নেই। এবং খুব সম্ভবত আমাদের মা - কাকিমাদের সাথে এগুলো হারিয়ে যাবে।

আয় আয় আয় 
শেয়ালে বেগুন খায়
তারা নুন কোথায় পায়
নদীর চরের বালিগুলো 
নুন ভেবে খায়

*******************


খোকা ঘুমল পাড়া জুড়ল

বর্গী এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কীসে
কীসের মাসি কীসের পিসি
কীসের বৃন্দাবন
এতদিনে জানতে পেলাম
খোকা আমার ধন


( ঊপরের গানটিতে "খোকা" কথাটির জায়গায় সাধারণত যে ছোট ছেলে বা মেয়েটির জন্য গানটি গাওয়া হচ্ছে, তার ডাকনাম ব্যবহার করা হয়। সকল feministদের কাছে মার্জনা চেয়ে আমি "খোকা" কথাটি ব্যবহার করলাম।)
এই গানটির একটা version যদিও youtube এ পাওয়া যায়, তবু আমি যে গানটি শুনে বড় হয়েছি, সেটাই উপরে লিখলাম। 

পুনশ্চ  ঃ

একটা গানের কথা এখানে না বললে আমার এই লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এই গানটা যদিও youtube এ আছে তবুও এই গানটার মানে আমার কাছে অনেক। আমার বাবার একটা HMV Fiesta gramaphone record player ছিল। সেটি আজও চলে, যদিও আওয়াজটা নষ্ট হয়ে গেছে। Speakerটা একটা বিচ্ছিরি রকমের খ্যারখ্যার করে। তবুও আমি প্রানে ধরে ওটা ফেলতে পারিনি। আমার বাবা আলপনা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি গান গেয়ে আমায় ঘুম পাড়াতেন যার স্মৃতি আজও আমার মনে উজ্জ্বল। এই গানটি আমি বহুবার ছেলেবেলায় বাবার কোলে বসে এই একই record playerটাতে শুনেছি। গানটির কথা নিচে রইল - 


ছোট্ট পাখি চন্দনা

ও আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা
একটি শিসে জাগিয়ে গেল
লাগছে তাও মন্দ না
ও আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা

ছোট্ট চাঁপার কলি শোন

শোন তোমায় বলি শোন
শোন তোমায় বলি
আমার এ মন মাতিয়ে গেল
সে শুধু তার গন্ধ না
লাগছে তাও মন্দ না
ও আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা

কালো দীঘির কোলে কোলে

ছোট্ট শালুক দোদুল দোলে
ছোট্ট শালুক দোলে
তারও চলে রাত্রি জেগে
দূরের চাঁদের বন্দনা
লাগছে তাও মন্দ না
ও আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা

ছোট্ট দুটি কথা

ভরা মুখরতা
আমার হৃদয় দুলিয়ে দিল
সে শুধু তার ছন্দ না
লাগছে তাও মন্দ না
ও আমার ছোট্ট পাখি চন্দনা
একটি শিসে জাগিয়ে গেল
লাগছে তাও মন্দ না
https://www.youtube.com/watch?v=ZljyCKOIvCE




আমার পুত্রকে যেদিন কোলে বসিয়ে এই গানটি শোনাচ্ছিলাম, যেমন আমি ওর বয়েসে আমার বাবার কোলে বসে এই একই record playerটাতে শুনতাম, সেদিন এক অদ্ভুত ভালোলাগার সাথে বাবার কথাও খুব মনে পড়ছিল। 

Wednesday, August 7, 2013

ছোট্টগল্প - একটা নতুন ধরনের (Short Story - a new format)

আমাদের বাড়িতে একবার অধ্যাপিকা মৌ চট্টোপাধ্যায়, অধ্যাপক দেবপ্রিয় সান্যাল, লেখিকা পারমিতা ঘোষ মজুমদার, এবং আমার বন্ধুবর শুভায়ন দে আড্ডা দিতে আসেন। সেই সন্ধ্যায় আড্ডার শর্ত ছিল যে আমরা অর্থাৎ সুভায়ন, আমার স্ত্রী দিপ্তী এবং আমি একটি ছোটগল্প লিখে শোনাব। আমি কোনকালেই কিছু লিখি নি তাই ভেবেছিলাম কেন লোক হাসাব, কিন্তু সেদিন দুপুরে চান করতে গিয়ে হঠাৎ এই গল্পটা মাথায় এল। ঝোঁকের মাথায় লিখেও ফেললাম।

পরে আড্ডায় গল্পটা শুনিয়ে আমায় শুনতে হয়েছিল - "এটা আর যাই হোক, ছোটগল্প হয়নি।"

তাই আদর করে এর নাম দিয়েছি - ছোট্টগল্প।

গিন্নির প্রচুর চোখ রাঙ্গানির পর আজ আমার ব্লগে এটা দিলাম। কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়াই।


ছোট্টগল্প 


তার সুরটা – তার সুরটা চেনা চেনা বলে ছোঁয়াচ লাগে

কলকাতাতে সন্ধ্যে হবার একটু আগে... 


‘ বাবু একটা টিকিট নাও না’। চমকে তাকিয়ে দেখি Calcutta Rowing Clubএর signalএ দাড়িয়ে থাকা আমার গাড়ির জানলার পাশে এক মহিলা। আজ একটু বাদলা বাদলা ছিল তাই জানলার কাঁচ নামিয়ে আসছিলাম। আর সেটাই হল কাল। মহিলা একটা ধামসা লটারির টিকিট আমায় গছাতে চায়। ‘মাফ কর’ বলবার জন্য হাতটা কপালে উঠতে গিয়েও থমকে গেল।

একই দিন একই রাত সব দেশে আসে যায়
প্রথম মায়ের চুম্বন হয়ে পৃথিবী বাঁচতে চায় মহিলাকে দেখে 


কেমন জানি ‘জালি’ মনে হল না। কেন জানি মনে হল না যে নেশাভাং করার জন্য ঠকিয়ে কিছু বাজে লটারির টিকিট বিক্রি করছে। ভাল ঘরের মহিলা অভাবে পড়েছে বলেই মনে হল। তথাকথিত কোনও সেন্টিমেন্টাল গল্প নয়, বরং চেহারায় একটা সম্ভ্রম এবং তার এই কাজ করার জন্য কোথাও একটা কুন্ঠা আছে বলে মনে হল।

‘কত দাম?’

‘তিরিশ টাকা। দশ কোটি টাকা first prize’।

First prize উচ্চারণটা স্পষ্ট Englishএ। আমি তাকালাম। Signalএর timerএ 15 second বাকি। Wallet খামচে ৫০ টাকার নোট বেরোল।

‘ তোমার পছন্দ মত একটা টিকিট দাও। যে কোন একটা’।

 টিকিটের বইটা হাতড়ে মাঝখানের একটা টিকিট ছিঁড়ে আমার হাতে দিল।

‘ বাবু তুমি জিতবে দেখে নিও’। ‘বেশ! তাহলে তুমি বাকি কুড়ি টাকাটা রেখে দাও’

আমি হাসলাম। Signal এর রঙ সবুজ। গাড়ি চলল Lake Gardens এর রাস্তা ধরে।

কখন সময় আসে জীবন মুচকি হাসে
ঠিক যেন পরে পাওয়া চোদ্দ আনা... 

আজ আবার সকাল থেকে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হচ্ছে, রাস্তায় জল থৈথৈ, তাই –

ধরা যাক আজ রোববার কোন কাজ নেই 
ধরা যাক আজ রোববার কোন তাড়া নেই 
শুয়ে থাকা যাবে যত চাই সারা বিছনায় 
বেশ করব, শুয়ে থাকব, আজ রোববার 

আজ অফিস কাট। খিচুড়ি, মামলেট আর বেগুনি। খবরের কাগজটা ওলটাচ্ছিলাম, হঠাত মনে পড়ল টিকিটটার কথা। খুলে দেখি গতকাল রেজাল্ট বেরিয়ে গেছে। গতকালের কাগজটা খুলে দেখি ‘কেল্লা ফতে’।  
বেড়ালের ভাগ্যেও শিকে ছেঁড়ে তাহলে!

 ওই দূর অঢেল সবুজের সমারোহ 
পাহাড়ের গায়ে হাল্কা নরম রঙ 
রোদ্দুরে শুধু ঝলমলে বিদ্রোহ রোদ্দুরে 
শুধু দিগ্বিজয়ের ঢঙ রোদ্দুরে 

 তারপর কি করে মিডিয়ার নজর এড়িয়ে, IT কেটে সাত কোটি টাকা Fixed Deposit করে রাখলাম, তারপর চাকরি ছাড়লাম এবং পুরো ব্যাপারটা গোপন রাখলাম, সেটা বলতে গেলে একটা আলাদা গোটা বড়গল্প হয়ে যাবে। তা আমি এখন বেশ আছি। তা মাস গেলে লাখ পাঁচেক টাকা এমনি এমনি এলে কেই না থাকে? বেশ একটা ফুরফুরে ভাব। খাচ্ছি দাচ্ছি বাঁশি বাজাচ্ছি। আর প্রচুর ঘুরছি।

গাঙ্গুর হয়েছে কখন কাবেরি কখন বা মিসিসিপি
কখন রাইন কখন কঙ্গো নদীদের স্বরলিপি 

 অনেকগুলো সখ যেগুলো অপূর্ণ ছিল সেগুলো পূরণ করেছি – যেমন গীটার শিখেছি, পিয়ানো শিখেছি – খারাপ বাজাচ্ছি না। না, Band খোলার কোন ইচ্ছে নেই। সবকিছুতেই একটা ‘করতে পারি কিন্তু কেন করব’ ভাব। এতে একটা অন্য রেলা আছে কিন্তু। বেশ ভালই আছি। কখন Alaska বেড়াতে যাচ্ছি, কখন Louvre দেখতে যাচ্ছি, আবার কখন Aurora Borealis দেখতে যাচ্ছি। মানে basically গরম দেশগুলো avoid করছি। সারা জীবন তো ঘামতে ঘামতেই গেল। তাই আর কি। হে হে! আর হ্যাঁ – কলকাতা ছাড়তে পারিনি।

বেদম traffic jam ঠাণ্ডা salami ham
Chocolate Cadbury Mother Dairy
আমাদের জন্য – সব আমাদের জন্য

প্রচুর air miles জমছে foreign trips গুলো থেকে। সেগুলো ভাঙিয়ে domestic trip গুলো করি। হে হে। মানে মধ্যবিত্ত mentality টা যায়নি আর কি। যাই হোক। Online একটা program থেকে 30 days এর মধ্যে Spanishটা শিখে ফেলেছি। তাই ভাবলাম Spainটা ঘুরেই আসি। তা মাদ্রিদের রাস্তায় একটা cafeতে বসে Toast আর caviar খাচ্ছি। হাতে আমার গিটার আর পেটে চারটে single malt আর গলায় –

The wind is knocking on the window pane 
A wish! A wish to change again 
The wind whispers come and change with me 
Things change, keeps changing silently

চারদিকে হাল্কা একটা ভিড়, পেটে আরও এক পাত্তর single malt, বেশ একটা রূপকথা রূপকথা ভাব, হটাৎ phoneটা বেজে উঠল।
আমার কলকাতার vodafoneএর numberটা international roamingএ থাকে। Phoneটা তুলে দেখি “Kanaida Gym Trainer”। সত্যিই তো। কলকাতায় এখন প্রায় সকাল সাড়ে ছটা বাজে। কানাইদা কে কি বলতে ভুলে গেছি যে আমি কলকাতায় নেই তাই আজ আর exercise করব না। এদিকে single maltএর দৌলতে চোখের পাতা ভারি হয়ে গেছে, চোখের পাতা টেনে খুলে বললাম, ‘হ্যালো’
ওপাশ থেকে আওয়াজ এল, ‘দাদা দশ মিনিটের মধ্যে আসছি, আপনি নামুন’।
‘কানাইদা, আজ শরীরটা ভাল নেই, আজ থাক’।
‘ ও। ঠিক আছে। তাহলে মঙ্গলবার কিন্তু .........’
‘ ঠিক আছে’।
দশ কোটি টাকার স্বপ্ন ভেঙে গেলে কার আর রোববার সকালে exercise করতে ভাল লাগে। কাজের লোক এসে চা দিয়ে গেল। সেই bad tea খেয়ে মাথা ধরাটা একটু ছাড়ল। মুখটা ভেটকে বসে রইলাম পটির অপেক্ষায়।

একটুর জন্য কত কিছু হয়নি 
ক্ষয়ে যাওয়া আশা তবু পুরোটা ফুরয়নি। 
একটুর জন্য কত কিছু হয়নি 
ক্ষয়ে যাওয়া আশা তবু পুরোটা ফুরয়নি।




 ** গানগুলো সব সুমন চট্টোপাধ্যায়  তথা অধুনা কবির সুমনের সৃষ্টি। আমি তার গানের কথাগুলো ব্যবহার করেহি মাত্র। এটা আমার তাঁর প্রতি স্রদ্ধা জানাবার এক বিনম্র চেষ্টা মাত্র।