Sunday, November 3, 2013

বন্ধু, কি খবর বল ...

সুমন চট্টোপাধ্যায়ের লাইভ অনুষ্ঠান - নজরুল মঞ্চ।(বোধহয় প্রথম - ঠিক জানা নেই)
সালটা ছিল ১৯৯৩ কি ১৯৯৪, ঠিক মনে নেই। ১৯৯৩ হয়ত হবে কারন তখনও "বসে আঁকো" albumটি বেরয়নি। আমি তখন ক্লাস এইটের ছাত্র। ডন বস্কো স্কুলে পড়ি।
তার বছরখানেক আগে "তোমাকে চাই" রিলিজ করেছে এবং আমার মত অনেকের মাথা আক্ষরিক অর্থে ঘুরিয়ে দিয়েছে। আমার বাড়িতে তখন "তোমাকে চাই" এর দুখানা ক্যাসেট। প্রথমটা প্রায় নষ্ট হয়ে গেছে। তোমাকে চাই আর আমাদের জন্য গান দুটো মুছে গেছে - এতবার শুনেছি।
একদিন আমার বড়দি বলল, " সুমনের একটা প্রোগ্রাম হবে, যাবি?' যাব না মানে? আলবাত যাব। যাই হোক, আমার জামাইবাবুর কোন এক পুলিশ বন্ধু টিকিটের ব্যবস্থা করে দেবেন। তা আমরা মানে বড়দি, ছোড়দি আর আমি সেইমত সন্ধ্যে নাগাদ নজরুল মঞ্চে পৌঁছে গেলাম। সেকি ভিড়। এবং জামাইবাবুর সেই বন্ধু শেষমুহুর্তে ঘোষণা করলেন যে সাংঘাতিক চাহিদা, তাই দুটোর বেশি পাস জোগাড় করতে পারেননি। কোন কিছু বুঝবার বা ভাববার আগে সবাইকে হলে ঢুকে যেতে হল কারন অনুষ্ঠান শুরু হতে চলেছে। বড়দি যাবার আগে কোনমতে ব্যাগ খামচে কিছু টাকা বের করে দিয়ে বলল, 'দেখ যদি কোন টিকিট পাস, নয়তো বাসে করে বাড়ি চলে যাস।"
আচমকা ব্যাপারটা সামলে নিয়ে দেখি হাতে ১৫ টাকা। হ্যাঁ, ২২১ বা শ্যামবাজার - গোলপার্ক মিনিবাসে করে জোড়া গির্জার কাছে আমার বাড়ি নিশ্চয়ই যাওয়া যাবে কিন্ত টিকিট? আজও স্পষ্ট মনে আছে টিকিটের দাম ছিল ১৫, ২৫, ৩০ ও ৪৫ টাকা। Probability কাকে বলে তখন জানতাম না (আজও বুঝি না, বোঝার বৃথা চেষ্টাও করি না) কিন্ত এটা বেশ বুঝতে পারলাম, যে টিকিট পাবার সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ।
যাই হোক, VIP Gate থেকে হেঁটে রাস্তায় এলাম। পরের দিন arithmetic পরীক্ষা। Class test. আমি চিরকাল যাকে বলে mediocre student. তার ওপরে অঙ্কে যাকে বলে বেশ আতঙ্ক। অঙ্কের টিচার Mr. Wheatley বিশেষ শুবিধের নন। (আমার সহপাঠীরা বোধহয় খুব একটা আমার সাথে এ ব্যাপারে অমত হবে না।) আগের class test গুলোতে খুব একটা ভাল নম্বর নেই।
কিন্তু এভাবে বাড়ি চলে যাব? কোন মানে হয়? যাই হোক, ভাবলাম, খোলা মঞ্চ, বাইরে থেকে নিশ্চয়ই আওয়াজ শোনা যাবে। একটা বসার জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে। এইসব ভাবছি আর এদিক ওদিক চাইছি - হঠাৎ একজন ভদ্রলোক বলে উঠলেন, "একটা টিকিট আছে, বিক্রি করব।"
কিছু বোঝবার আগেই হাতটা উঠে গেল এবং চেঁচিয়ে উঠলাম, "আমি নেব।" তখনও জানি না কত টাকার টিকিট। আরও অনেকেই স্বাভাবিকভাবে এগিয়ে এলেন, কিন্তু ভদ্রলোক আমার দিকে একটা অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে বললেন, " এই ছেলেটিকেই দেব"। (আমি কিন্তু তখনও জানি না ভদ্রলোকের কাছে কত টাকার টিকিট আছে।) যখন দেখলাম ভদ্রলোকের কাছে ১৫ টাকার টিকিট আছে তখন সবকটা দাঁত আপনাআপনি বেরিয়ে পড়ল। প্রোগ্রামটা আজ আমার দেখারই ছিল। কেউ শালা আটকাতে পারবে না।
দৌড়ে গিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখলাম, গ্যালারির সবচেয়ে পেছনের (নাকি সবচেয়ে উঁচু?) রো তে সিট। তাই সই। বসে ঘামটাম মুছলাম। দুই দিদিকে একদম সামনের সারিতে দেখতে পেলাম, এবং জীবনে প্রথমবার নজরুল মঞ্চের ভেতরটা ভাল করে দেখতে না দেখতে সুমন মঞ্চে প্রবেশ করলেন।
নীল ডেনিম শার্ট এবং নীল ডেনিম প্যান্ট (জিনসের প্যান্ট নামে বেশি পরিচিত) পরা সুমন পুরো নাইন্টি ডিগ্রি সামনে ঝুঁকে একটা প্রনাম করলেন। আমার সত্যি তখন মনে হয়েছিল যে লোকটার একটা বেশ ছুঁচলো ভুঁড়ি আছে এবং একটা যাকে বলে প্রমিসিং টাক আছে - তার এরকম একটা বাড়াবাড়ি না করলেই ভাল হত। যাই হোক, মঞ্চে দেখলাম একধারে একটা একুইস্টিক গীটার, এবং আরেকধারে তিনটে synthesiser, U - shape এ সাজিয়ে রাখা। যারা সুমনের অনুষ্ঠান দেখেছেন তারা বুঝতে পারবেন আমি কি বলছি। মানে সুমন যখন বাজাবেন, তখন তার সামনে একটা এবং যথাক্রমে দুদিকে দুটো synthesiser থাকবে।
প্রথমে ভাবলাম লোকটা বাজাবে কি করে? তারপর যা দেখলাম, তা বোধহয় বাংলা তথা ভারতের সংগীত পরিবেশনার ক্ষেত্রে এক বিপ্লব। (গানগুলো তো আগেই বিপ্লব এনে ফেলেছে।)
একের পর এক অনবদ্য গান, নজরুল মঞ্চের স্ফটিকস্বচ্ছ acousticএ সুমনের জলদগম্ভীর আওয়াজ - আমার জীবনের সেরা সন্ধ্যেগুলোর মধ্যে একটা। একটা লোক - শুধু একটা লোক স্রেফ গীটার বাজিয়ে গেয়ে চলেছেন, কথা বলছেন দর্শকদের সাথে, গল্প বলছেন, আবার মঞ্চের অন্যদিকে হেঁটে গিয়ে synthesiser বাজিয়ে গাইছেন, rhythm programmerএ beats  বাজছে। যখন interlude এর সময় আসছে তখন একটা হাথে সামনের synthesiser আর অন্য হাথে হয় ডানদিকের নয় বাঁদিকের synthesiserটা বাজাচ্ছেন। অনবদ্য।যে গানগুলো গেয়েছিলেন তার কিছু কিছু মনে আছে - পাপড়ির গান, তোমাকে অভিবাদন, গ্যালারিতে বসে গ্যালিলিও, বন্ধু কি খবর বল (টিকিটে এই কথাটা লেখা ছিল, তখনও জানতাম না যে এটা আসলে একটা অনবদ্য গান), এবং আরও অনেক গান।
এবার যাকে বলে Interval.
দেখলাম কেউ মোটামুটি নড়ছে না। দিব্যি করে বলছি, লোকটাকে আরও কাছ থেকে দেখব আর শুনব বলে ভাল ছেলের মত হেঁটে VIP Gate দিয়ে ঢুকে সামনের সারিগুলোতে দিদিদের কাছাকাছি একটা সোফায় গিয়ে বসলাম। আর কোন উদ্দেশ্য ছিল না।
Interval এর পরে সুমন আবার এলেন। আবার পুরো হল জাদুতে ভেসে গেল। কখন যে নটা বেজে গেল আমরা কেউই বুঝতে পারিনি। অনুরোধ আর থামতেই চায় না। কিন্তু অনুষ্ঠান শেষ করতে হবে। তারপর এক অসাধারন ঘটনার সাক্ষী রইলাম জীবনে প্রথমবার - আমরা সবাই। সুমন হঠাৎ বলে উঠলেন, "আসুন আমরা সবাই মিলে একটা গান করি। রবীন্দ্রনাথের গান।" সবাই বেশ অস্বস্তিতে। মানে রবীন্দ্রসঙ্গীত, আবার তাও আবার গীটার আর synthesiser দিয়ে? মানে সুমন তো ঠিক রবীন্দ্রসঙ্গীত গায় কি? এক কথায় puritan বাঙালি খুব চাপে।আবার যে লোকটা এরম ফাটাফাটি গাইল, তাকে ঠিক খরচের খাতায় ফেলাও যাচ্ছে না।
সুমন বললেন, " আসুন আমরা তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী, এই গানটা গাই।" আমি গানটা সেদিন জানতাম না এবং তার জন্য নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারিনি। তিন - সাড়ে তিন হাজার লোক একসাথে গান গাইলে কি হতে পারে তার জাদুকরি অভিজ্ঞতা সেদিন আমার প্রথম হয়েছিল। সুমন দুটো লাইন শুধু পুরুষদের গাইতে বলছিলেন, আবার তার পরের দুটো লাইন শুধু মহিলারা গাইছিলেন। আবার দুটো লাইন সামনের সারির সবাই গাইছিলেন আবার তার পরের দুটো লাইন পেছনের সারির সবাই গাইছিলেন। পরে অনেক অনুষ্ঠানে সুমন এই ভাবে সবাইকে গাইয়েছেন, একসাথে গেয়েছেন, কিন্তু সেদিন প্রথমবারের একসাথে গান গাওয়াতে আমিও সবার মাঝে ছিলাম। Harmony কাকে বলে সেদিন প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছিল। গানের শেষে সুমন হাউহাউ করে কেঁদেছিলেন। আমাদেরও সবার চোখ আবেগে চিকচিক করেছিল। একরাশ ভাললাগা আর কিছু অনবদ্য স্মৃতি নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরেছিলাম। তার রেশ আজও কাটেনি। আজও সেই সন্ধ্যার কথার মনে করলে মন ভাল হয়ে যায়। এক কিশোরের arithmetic পরীক্ষাকে অগ্রাহ্য করে, বিদ্রোহ করে, ভাগ্যের সাথে লড়ে, ১৫ টাকার জুয়া খেলে এক জাদুকরি সন্ধ্যার সাক্ষী হয়ে থাকা।
Yes! I was a part of that magical evening. I was a part of history,
সুমনবাবু, ধন্যবাদ!
দেখা হবে তোমায় আমায় অন্য গানের ভোরে - এই আশায় থাকলাম। ভাল থাকবেন।

2 comments: